পুণ্য মহালয়ার ভোরে যে সুর, যে সংগীত, যে ভাষ্য না হলে আমাদের পুজোটাই শুরু হয় না সেই লহরীর নাম মহিষাসুরমর্দিনী। আকাশবাণী কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় এই অনুষ্ঠানটি পুজোর আবহাওয়া বয়ে আনে। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত প্রবাদপ্রতিম তিনজন মানুষ হলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, বাণীকুমার, এবং এক ও অদ্বিতীয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। রেডিওর কোনও অনুষ্ঠান যে কতটা জনপ্রিয় হতে পারে, এই অনুষ্ঠানটিই তার প্রমাণ। কিন্তু এই অনুষ্ঠানটির মধ্যেও লুকিয়ে আছে অনেক ইতিহাস এবং ইতিহাসের অন্ধকার।
১৯৩০ সালে ভারতীয় বেতারের সরকারিকরণের পর নাম হয় ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’। এই সময় সংগীত নির্ভর অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৯৩২ সালের মার্চ মাসে বাণীকুমার মার্কন্ডেয় চণ্ডীর বিষয়বস্তু অবলম্বনে বসন্তেশ্বরী নামে একটি চম্পু রচনা করেন।
পন্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী, পঙ্কজকুমার মল্লিক এই অনুষ্ঠানের সুর সংযোজন করেন। রাইচাঁদ বড়ালের সংগীত পরিচালনায় এ অনুষ্ঠানটি নির্মিত হয়। নাট্যকথাসূত্র ও গীতাংশ গ্রহণ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং বাণীকুমার চণ্ডীর কয়েকটি শ্লোক আবৃত্তি করেন। এটি সে বছর অষ্টমীর দিন বাজানো হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানটির মত করে ১৯৩২ সালে অন্য একটি অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। মহিষাসুর বধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি গীতিআলেখ্য। তখন অবশ্য এ অনুষ্ঠানের নামকরণ করা হয়নি। ‘বিশেষ প্রত্যুষ অনুষ্ঠান’ হিসেবে এর প্রচার হয়। ১৯৩৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মহালয়া তিথিতে সকাল ৬টা-৭টা এই অনুষ্ঠান প্রথম প্রচারিত হয়। মহিষাসুরমর্দিনীর সংগীত পরিচালক পঙ্কজকুমার মল্লিক হলেও ‘অখিল বিমানে’, ‘আলোকের গানে’- এই গানগুলির সুর দেন হরিশ্চন্দ্র বালী। ‘শান্তি দিলে ভরি’র সুর দেন সাগির খাঁ।
বর্তমান রেকর্ডে আমরা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের যে ধরনের চণ্ডীপাঠ শুনি, প্রথমদিকে কিন্তু উনি ওইভাবে উচ্চারণ করতেন না। পুরো দলটিকে যথাযথ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন অধ্যাপক অশোকনাথ শাস্ত্রী বেদান্ততীর্থ। এই অনুষ্ঠানটি আবার ষষ্ঠীর সকালে ফিরে এসেছিল ১৯৩৬ সালে। নাম ছিল মহিষাসুর বধ। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে এই অনুষ্ঠান। আর হবে নাই বা কেন, প্রচুর গুণী মানুষের সমাবেশ, তাঁদের আলোচনা, নতুন কিছু করার অদম্য চেষ্টা এবং বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠা তাঁদের এই অনুষ্ঠানকে শ্রোতাসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। এই অনুষ্ঠানের গায়কেরা ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী, মানিকমালা, প্রফুল্লবালা, বীণাপাণি প্রমূখ।
অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় যেমন হয়েছিল তেমনি এটিকে ঘিরে একটি বিতর্ক তুলেছিলেন তৎকালীন গোঁড়া ব্রাহ্মণসমাজ। তাঁরা বলেছিলেন, পুণ্য মহালয়ার ভোরে অব্রাহ্মণের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনানোর কোনও যৌক্তিকতা নেই। এই ঘটনার পর অনুষ্ঠানটিকে সরিয়ে ষষ্ঠীর ভোরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু শ্রোতাদের বিপুল চাপে ১৯৩৬ সাল থেকে পুনরায় অনুষ্ঠানটিকে মহালয়া তিথিতেই বাজানো শুরু হয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক শিল্পীর অনুষ্ঠানটির সঙ্গে একাত্মতা ছিল দেখবার মত। লাইভ সম্প্রচারের সময় সমস্ত কলাকুশলী ভোররাতে স্নান সেরে শুদ্ধ আচারে উপস্থিত হয়ে যেতেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ পরতেন গরদের জোড়, কপালে চন্দনের ফোঁটা।
এভাবে যখন অনুষ্ঠানটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে সেইসময় ১৯৭৬ সালে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই অনুষ্ঠানটি বাতিল করে একটি অন্য অনুষ্ঠান বাজানো হবে মহালয়া তিথিতে। এই অনুষ্ঠানটির নাম দেবীদুর্গতিহারিণী। এটি লিখেছিলেন ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গান লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত। নির্বাচিত কিছু ভাষ্যপাঠ করেছিলেন উত্তমকুমার। এ অনুষ্ঠান দর্শকেরা একেবারেই গ্রহণ করেননি। মহিষাসুরমর্দিনীকে বাদ দেওয়ার জন্য ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সাধারণ মানুষ। তৎকালীন আকাশবাণীর জনপ্রিয় উপস্থাপক মিহির বন্দ্যোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছেন, ‘দেবীদুর্গতিহারিণী অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের মধ্যপথেই টেলিফোনে শ্রোতাদের অবর্ণনীয় গালিগালাজ আসতে শুরু করে অকথ্য ভাষায়। অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই আকাশবাণী ভবনের সামনে সমবেত হয় বিশাল জনতা। ফটকে নিয়োজিত প্রহরীরা সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যান। ফটকের গেট ভেঙে ঢুকে পড়তে চায় উত্তাল মানুষের দল।’ শোনা যায়, পরবর্তীকালে উত্তমকুমারও তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন।
এভাবে মহিষাসুরমর্দিনীকে সরিয়ে দেওয়ায় মর্মাহত হয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক। একটা অনুষ্ঠানের প্রতি মানুষের কী রকম ভালবাসা থাকলে এ রকম প্রতিক্রিয়া সম্ভব, তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। সে বছর ষষ্ঠীর দিন এ অনুষ্ঠান বাজানো হয় এবং ১৯৭৭ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত মহালয়ার ভোরেই বাজানো হয় মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটি।
কিন্তু যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের উদাত্ত কণ্ঠের জাদুতে এই অনুষ্ঠান এখনও পর্যন্ত স্বমহিমায় জীবিত সেই মানুষটিকে শেষজীবনে অনেক দুঃখ সহ্য করতে হয়েছে। আকাশবাণীকে নিজের সন্তানের মত করে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। নাটক প্রযোজনা, অভিনয়, গানের অনুষ্ঠান, চাষবাসের অনুষ্ঠান- সবরকম অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন সমান সাবলীল। এমন কি, বেতারের পাক্ষিক পত্রিকা বেতার জগত-এর কপি তিনি জিপিও-র সামনে দাঁড়িয়ে নিজে হাতে বিক্রি করেছেন। শ্রীবীরূপাক্ষ ছদ্মনামে লিখেছেন অনেক লেখা। এহেন প্রবাদপ্রতিম মানুষটি অবসরের পরও ‘সাপ্তাহিক মহাভারত পাঠ’ এবং ‘মজদুর মন্ডলীর আসর’-এ আসতেন। এসময় একদিন আকাশবাণীর জনৈক দ্বাররক্ষী তাঁর কাছে পাস চেয়ে বসেন। সেদিন প্রচন্ড অপমানিত বোধ করে ক্রোধে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন তিনি। চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘এই রেডিও’কে জন্ম দিয়েছি আমি, আমার কাছে অনুমতিপত্র চাইছ!’ সত্যিই তো, আকাশবাণী কর্মীরা তো এখনও এই নামটিকে (বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র) পুজো করেন।
প্রতি বছর শিশিরে পা ভিজিয়ে বঙ্গে মহালয়ার যে পুণ্যপ্রভাত উপস্থিত হয়, সেখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এখনও অমর হয়ে রয়েছেন। প্রতি বছর উনি কাঁদেন। আমাদের কাঁদান। বাঙালির জন্য দুর্গোৎসবের দরজাটাকে উনি হাট করে খুলে দেন। অপমানের আওয়াজগুলোকে ঢাক আর কাঁসরের আওয়াজ দিয়ে ঢেকে রাখেন।
শঙ্খ অধিকারী, প্রাবন্ধিক, সংগঠক