প্রবন্ধ : সনাতনধর্মে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বিশ্বশান্তি । ড. অসীম সরকার

সংস্কৃত ধৃ-ধাতুর উত্তর মন্ প্রত্যয়যোগে ধর্ম শব্দটি গঠিত হয়েছে। ‘ধৃ’ধাতুর অর্থ ধারণ করা। যা মানুষকে ধারণ করে রাখে তাই ধর্ম অর্থাৎ যা ধারণ করে মানুষ সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও পবিত্র জীবন যাপন করতে পারে এবং যা মানুষের সকল কল্যাণ সাধন করে তাকেই বলে ধর্ম। সহজভাবে বললে যা আমাদের কল্যাণের পথে ধরে রাখে তাই ধর্ম।

স্বাভাবিক গুণ বা নৈতিক চরিত্র অর্থে ধর্ম শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়। আধ্যাত্মিক শক্তির সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্পর্কের অনুভূতিই ধর্ম। মূল কথা হচ্ছে, মিলন ও একাত্মতার নীতি এবং নৈতিক শিক্ষার উপায়ই ধর্ম। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন— ‘শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম,

দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ। স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ। সত্যই সকল ধর্মের ভিত্তি। পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ। সৎ হওয়া আর সৎ কর্ম করা ধর্মের অঙ্গ।’ প্রতিটি বস্তুর একটি নিজস্ব ধর্ম আছে; অর্থাৎ কোনও বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কিত গুণাবলিই তার ধর্ম। যা না

থাকলে বা যার অভাবে কোনও বস্তু আর সেই বস্তু থাকে না, সেটাই তার ধর্ম।

যেমন অগ্নির স্বভাব হচ্ছে দগ্ধ করা। যে মুহূর্তে অগ্নির এই দাহিকাশক্তি থাকবে না, সে মুহূর্তে অগ্নিরও আর অস্তিত্ব থাকবে না। অতএব, অগ্নির ধর্ম হচ্ছে দাহিকাশক্তি বা দগ্ধ করা। মানুষেরও নিজস্ব একটি ধর্ম রয়েছে। যেসব গুণ থাকলে মানুষকে মানুষ বলা হয় এবং না থাকলে মানুষ বলা চলে না; যা চলে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না সেটাই মানুষের ধর্ম। এর নাম মনুষ্যত্ব। এই মনুষ্যত্বই মানুষকে মানুষ নামে পরিচিতি দান করে। অতএব মানুষের ধর্ম হচ্ছে মনুষ্যত্ব। যার মনুষ্যত্ব নেই, সে পশুর সমান (মনুষ্যত্বহীনাঃ পশুভিঃ সমানাঃ)। মনুষ্যত্বহীন মানুষের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। ধর্ম পালন করলে সেই পাশবিক প্রবৃত্তির বিনাশ ঘটে। জেগে ওঠে মানবিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ এবং পবিত্রতায় পরিস্নাত এক শুদ্ধ কল্যাণ-অনুভব। এই কল্যাণবোধই ধর্ম। ধর্মের লক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে—

অহিংসা সত্যমস্তেয়ং শৌচং সংযমমেব চ
এতৎ সামাসিকং প্রোক্তং ধর্মস্য পঞ্চলক্ষণম্ \

অর্থাৎ হিংসা না করা, চুরি না করা, সংযমী হওয়া, শুচি থাকা এবং সত্যাশ্রয়ী হওয়া— এই পাঁচটি হচ্ছে ধর্মের লক্ষণ। মনুসংহিতায় ধর্মের লক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে—

বেদঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ
স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ।
এতচ্চতুর্বিধং প্রাহুঃ
সাক্ষাৎ ধর্মস্য লক্ষণম্ \ (মনুসংহিতা, ২/১২)

অর্থাৎ বেদ, স্মৃতি, সদাচার ও বিবেকের বাণী এই চারটিকে বলা হয়েছে সনাতন হিন্দুধর্মের সাক্ষাৎ লক্ষণ। বেদে বিশ্বাস রেখে, স্মৃতির অনুশাসন মেনে এবং মহাপুরুষদের সদাচার থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জীবনপথে চলতে হয়। এতেও যদি জীবনের সমস্যা সমাধান না হয় তখন সিদ্ধান্ত নিতে হয় নিজেকেই। শুনতে হয় বিবেকের বাণী। কাজে লাগাতে হয় নিজের অভিজ্ঞতাপ্রসূত কর্তব্য-অকর্তব্যের জ্ঞানকে। মনুসংহিতার মতে ধর্ম হচ্ছে কতগুলো গুণের সমষ্টি। উক্ত হয়েছে—

ধৃতিঃ ক্ষমা দমো ’স্তেয়ং
শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ।
ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধো
দশকং ধর্মলক্ষণম্ \ (মনুসংহিতা, ৬/৯২)

অর্থাৎ সহিষ্ণুতা (ধৈর্য), ক্ষমা (ক্ষমাশীলতা), আত্ম-সংযম, চুরি না করা, শুচিতা, ইন্দ্রিয়সংযম, শুদ্ধবুদ্ধি (প্রজ্ঞা), বিদ্যা (জ্ঞান), সত্য এবং অক্রোধ (ক্রোধহীনতা) এই দশটি হচ্ছে ধর্মের লক্ষণ। এই দশটি লক্ষণের মধ্যে ধর্মের স্বরূপ প্রকাশ পায়।

এই দশটি গুণ যিনি যথাযথভাবে অনুশীলন করতে পারেন তাঁর মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। অতএব এরূপ গুণবিশিষ্ট ব্যক্তি হচ্ছেন ধার্মিক। এ গুণগুলো যে-কোনও ব্যক্তির পক্ষেই অনুসরণযোগ্য। কাজেই বলা যায় যে, হিন্দুধর্ম কোনও বিশেষ স্থান, কাল, জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে ধর্মাচরণের বিধান দেয়নি। সকল দেশের, সকল কালের, সকল মানুষের পক্ষে যা কল্যাণকর সেটিই হচ্ছে হিন্দুধর্মের নির্দেশনা। হিন্দুধর্ম বহু মত ও পথের সমন্বয়ে সৃষ্টি। হিন্দুধর্মমতে প্রকৃতির অন্তবিহীন বৈচিত্র্যের মধ্যে যেমন এক বিস্ময়কর ঐক্য স্বীকৃত, তেমনি স্বীকৃত মানুষের চিন্তা-চেতনার বহুধা বিস্তারিত মত ও পথের সমন্বয়। অদ্বৈতবাদী, দ্বৈতবাদী, একেশ্বরবাদী, আস্তিক, নাস্তিক, শাক্ত, বৈষ্ণব প্রভৃতি বিভিন্ন ধারার বিশ্বাস, মত ও পথ এর ধর্মদেহে লীন হয়েছে একান্তভাবে। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন— ‘যত মত তত পথ’। ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’— এটাই হিন্দুধর্মের মূল চেতনা। মুক্ত বুদ্ধি ও মুক্ত চিন্তা এখানে স্বীকার্য। মানবিক মূল্যবোধে, মানবিক কল্যাণে যা কিছু তা এখানে গ্রহণীয়। চিন্তা-চেতনায় একটা গণতান্ত্রিক পন্থা এখানে লক্ষণীয়। ‘যত মত তত পথ’— এই দর্শন হিন্দুধর্মে স্বীকৃত যথার্থভাবে। এটা কেবল সম্ভব মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা, বিভিন্ন মত ও পথের প্রতি সীমাহীন সহিষ্ণুতা এবং প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ থেকে। হিন্দুধর্মের এই যে ঔদার্য, বিশালতা, মানবিক বিকাশের ধারা এবং তার অন্তরের সঞ্জীবনী শক্তি তা নিঃসন্দেহে নন্দিত।

প্রত্যেক ধর্মেরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলো তাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। হিন্দুধর্মেরও বিশেষ তত্ত্ব, কতগুলো ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মকৃত্য রয়েছে, যেগুলো হিন্দুধর্মের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। যেমন— ঈশ্বরতত্ত্ব, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি, কর্মবাদ, জন্মান্তরবাদ, অবতারবাদ, দেব-দেবীর পূজা, মোক্ষলাভ, জীব ও
জগতের কল্যাণ, নারীর প্রতি মর্যাদাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সমদর্শী ইত্যাদি।

সনাতনধর্মবিশ্বাসে কেবল সর্বজনীন সহনশীলতাই নয় বরং এখানে একটা দৃঢ় প্রতীতি আছে যে যদি কোনও একটি ধর্ম সত্য হয় তাহলে অন্য ধর্মগুলোও সত্য। হিন্দুধর্মের মতে তার স্বচেতনায় যেমন এক পরম সত্য দীপ্র, তেমনি অন্যের আবিষ্কৃত উপলব্ধ সত্যের প্রতিও সে শ্রদ্ধাবনত। এ ধর্ম বিশ্বাস করে, কোনও ভাল কথা যে কেবল একটি বিশেষ ধর্মে, কিংবা দেশে উচ্চারিত হবে এবং কোনও মহাপুরুষও যে কেবল একটি বিশেষ ধর্মে বা দেশে আবির্ভূত হবেন তা নয়। সকল ধর্মে, সর্বকালে এবং সব দেশেই হতে পারে অবিনাশী বাণীর উচ্চারণ ও মহিমান্বিত পুরুষের আবির্ভাব। হিন্দুধর্মের মানবিক ঔদার্য্য, চিন্তার প্রসারতা, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি বিচার বিশ্লেষণ করে একে যদি কেউ ‘মানবধর্ম’বলে তাহলে অত্যুক্তি হবে না।

সনাতনধর্মে কেবল মানুষ নয়, মনুষ্যেতর জীব এবং সকল জড় ও অজড়ের প্রতিও সুগভীর অনুভূতি, প্রগাঢ় ভালবাসা প্রোজ্জ্বল। জীব ও জগতের কল্যাণে আত্মনিবেদন করাই হিন্দুধর্মের প্রধান দিক। সকল জীবের মধ্যে ঈশ্বর দর্শন, সকলকে ভালবাসাই ধর্ম। রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছেন— ‘যত্র জীব, তত্র শিব।’ এই চেতনাটি স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় প্রতিফলিত হয়েছে অনুপমভাবে—

ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু সর্বভূতে সেই প্রেমময়,
মনপ্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে এ সবের পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর
জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন ও সাম্যের বাণী প্রচারই হিন্দুধর্মে মূল লক্ষ্য। বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীশ্রীচণ্ডীসহ প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই জীবের প্রতি ভালবাসার কথা, মানবকল্যাণের কথা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাম্যের (শান্তির) বাণী প্রচারিত হয়েছে। উক্ত হয়েছে—

 যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ \
        (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৪/১১)

— হে পার্থ, যে (ভক্ত) আমাকে যেভাবে উপাসনা করে (আমার প্রতি আত্মসমর্পণ করে), আমি তাকে সেভাবেই তুষ্ট করি। মনুষ্যগণ সর্বতোভাবে আমার পথেরই অনুসরণ করে।

ধর্মগ্রন্থসমূহে কেবল মানুষ ও জীবের কল্যাণই কামনা করা হয়নি, কামনা করা হয়েছে সমন্ত প্রকৃতি এবং জগতেরও শান্তি।

শ্রীচৈতন্য, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, হরিচাঁদ ঠাকুর, ঠাকুর অনুক‚লচন্দ্র প্রভৃতি মহাপুরুষগণের ধর্মচিন্তার প্রধানভিত্তি মানবতাবাদ। তাঁরা সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন এবং জীবের সেবা করেছেন। প্রচার করেছেন শান্তির বাণী। সাম্প্রদায়িকতাকে দূরীভূত করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে এক পতাকা তলে আনার চেষ্টা করেছেন এবং অন্যকে একাজে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।

জীবন-যাপন পদ্ধতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে পার্থক্য

থাকলেও সকল ধর্ম, গোত্র ও বর্ণের মানুষ সমান। মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদ নেই। মহাপুরুষগণও মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে কোনও প্রকার ভেদাভেদ কল্পনা করেন নি। সবাইকে একই সত্তা মনে করতেন, সকল মানুষকে মানুষ হিসেবে কল্পনা করতেন। তাঁরা কখনো ভাবেন নি কে কোন জাতের, কোন গোষ্ঠীর, কোন গোত্রের, কোন বর্ণের, কোন ধর্মের বা কোন অঞ্চলের। তাঁরা মানেন নি ধর্মে-ধর্মে বিভেদ, বিশ্বাস করেন নি জাতিভেদ প্রথা। বর্ণপ্রথাকে তাঁরা প্রবলভাবে ঘৃণা করতেন। তাঁরা ঘৃণা করতেন হিংসাকে, কূপমণ্ডুকতাকে, গোড়ামিকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমদৃষ্টিতে দেখতেন এবং সকল ধর্মের মানুষকে সমানভাবে ভালবাসতেন। শ্রীচতৈন্য মহাপ্রভু বলেছেন—

যেই ভজে, সেই বড়, অভক্ত হীন ছাড়।
কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি কুলাদি বিচার।
উত্তম হঞা বৈষ্ণব হবে নিরাভিমান।
জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান \

লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছেন—

ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য এসবই
জগতের ব্যবহারিক সত্য, মনের
সৃষ্টি। আমি যে জগতের লোক
সেখানে নেই কোনও ভেদ, সেখানে
সবই সমান-সবই সুন্দর।

হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন— ‘নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে, জগৎকে ভালবাসবে, সকল ধর্মে উদার থাকবে, জাতিভেদ করবে না।’ ঠাকুর অনুক‚লচন্দ্র বলেছেন— ‘তোমরা যে সম্প্রদায়েরই হও না কেন, মনে রেখ, ঈশ্বর এক, ধর্মও এক।’ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন— ‘প্রত্যেককে আমি কেন ভালবাসব? কারণ তারা সকলে এবং আমি এক।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘জগতে যত প্রাণী আছে সবাই তোমার আত্মার বহুরূপ মাত্র।’ সারদা দেবী বলেছেন— ‘যদি শান্তি চাও, কারও দোষ দেখ না, দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেখ, কেউ পর নয়, জগৎ তোমার।’ হিতোপদেশে বলা হয়েছে— ‘উদারচরিতানাং তু বসুধৈব কুটুম্বকম্’— উদার ব্যক্তিদের কাছে সমগ্র পৃথিবী তথা পৃথিবীর সকল মানুষই আত্মীয়। চাণক্য বলেছেন— ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু যঃ পশ্যতি স পণ্ডিতঃ’— সকল জীবকে যিনি নিজের মত করে দেখেন, তিনি পণ্ডিত (অর্থাৎ সমদর্শী)। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—

আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যো ’র্জুন।
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ \ (৬/৩২)

— হে অর্জুন, যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখ বলে অনুভব করেন (নিজের সুখ ও দুঃখের মত মনে করেন অর্থাৎ সকলকে সমদৃষ্টিতে দেখেন), আমার মতে (পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মতে) তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী অর্থাৎ মহাপুরুষ। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আরও বলেছেন—

বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ। (৫/১৮)

—পণ্ডিতগণ (ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষগণ) বিদ্যাবিনয়যুক্ত ব্রাহ্মণ, চÐাল, গো, হস্তী ও কুকুর সকলের প্রতি সমদর্শী হন অর্থাৎ সকলকে সমদৃষ্টিতে দেখেন।

কোনও ধর্মই হিংসার কথা বলে না, বিভেদের কথা বলে না, বলে শান্তির কথা। ধর্ম মানুষকে ঘৃণা বা হিংসা করতে শেখায় না, শেখায় ভালবাসতে এবং সভ্য হতে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী কুচক্রীমহলই ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করে থাকে। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র সমাধান হচ্ছে ধর্মের সাম্যবাণী এবং মহাপুরুষদের শাশ্বত আদর্শ মনে-প্রাণে ধারণ করে ব্যক্তিজীবনে তার প্রতিফলন ঘটানো, প্রয়োজন মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। মানবকল্যাণমূলক চেতনাকে মনে-প্রাণে ধারণ করে মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করা। তবেই মনুষ্যত্বের বিকাশ সম্প্রসারিত হবে। আর মনুষ্যত্বের বিকাশের মাধ্যমেই সাধিত হবে মানুষের তথা সমাজের কল্যাণ। এর ফলে মানুষের মধ্যে প্রকাশিত হবে মানবিক মূল্যবোধ।

সনাতনধর্মবিশ্বাসে বর্জন নয় গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, ধ্বংস নয় শান্তির কথাই উচ্চারিত হয়েছে এবং বিভেদ নয় সমন্বয়ের আহŸানই জানানো হয়েছে। ঋগ্বেদের শেষ সূক্তে (১০/১৯১) ঐক্যের আহŸান উচ্চারিত হয়েছে—

সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্।
    ... ... ...
সমানী ব আক‚তিঃ সমানা হৃদয়ানি বঃ
সমানমস্তু বো মনো যথা বঃ সুসহাসতি \

— তোমরা সংযুক্ত হও, একবিধ বাক্য প্রয়োগ কর, তোমাদের মনসমূহ জ্ঞাত হোক সমানরূপে। … তোমাদের সংকল্প সমান, তোমদের হৃদয়সমূহ সমান এবং সমান হোক তোমাদের অন্তঃকরণসমূহ। যাতে তোমাদের পরম ঐক্য হয়, তাই হোক।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন— ‘যুদ্ধ নয়, সহমর্মিতা; ধ্বংস নয়, সৃষ্টি; সংঘাত নয়, শান্তি ও সম্প্রীতি।’ তিনি আরও বলেছেন— ‘বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।’ বিশ্বশান্তির জন্য প্রয়োজন মহান ঐক্য ও সম্প্রীতির বাণী মনেপ্রাণে ধারণ করে কাজ করা।

সনাতনধর্মে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব— সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার— এই চেতনাকে মনেপ্রাণে ধারণ করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। সকলের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে দুর্গাপূজা হয়ে উঠে এক সর্বজনীন মহোৎসবে।

শারদীয় দুর্গাপূজার সর্বজনীনতা, হিন্দুধর্মের মানবকল্যাণমূলক মহান আদর্শ এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বের দর্শন ও মানবতাবাদের চেতনা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিভাত হোক। বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যকার সকল প্রকার বৈষম্য দূর হোক, দূর হোক মানুষের সঙ্গে মানুষের সকল প্রকার ভেদাভেদ। দৃঢ় হোক মানুষের সঙ্গে মানুষের সেতুবন্ধন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপিত হোক এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠুক। সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, বোমাবাজিসহ সকল প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অবসান হোক, জাগরিত হোক মানবিক মূল্যবোধ, বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক বিশ্বশান্তি।

ড. অসীম সরকার
শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন

মহিষাসুরমর্দিনী : বাঙালির মহালয়া | শঙ্খ অধিকারী

SanatanKatha

দ্বারকা : সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন নগরী | তৌফিকুর রহমান

SanatanKatha

মহাভারত: পূর্বাভাস । অনিন্দিতা বসু

SanatanKatha