দ্বারকা : সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন নগরী | তৌফিকুর রহমান

বহুকাল আগের কথা। কোনও এক বনের কোনও এক গাছের নিচে ধ্যানরত অবস্থায় ছিলেন একজন। বিশাল এক নগরীর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। হঠাৎ এক অসতর্ক শিকারীর তীরের আঘাতে নিহত হন তিনি। আর তার কিছুকাল পরেই সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যায় তার প্রতিষ্ঠিত সেই বিশাল নগরী। হারিয়ে যায় পৌরাণিক দ্বারকা নগরী।

বর্তমানের দ্বারকা ভারতের উত্তর-পশ্চিমের রাজ্য গুজরাটের একটি জেলা। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চারটি প্রধান ধর্মীয় স্থান বা ধামের একটি। দ্বারকা শব্দের ‘দ্বার’ অর্থ দরজা আর ‘কা’ অর্থ স্বর্গ কিংবা মোক্ষ। সে অর্থে দ্বারকা মানে ‘স্বর্গের দ্বার’ কিংবা মোক্ষলাভের উপায়। এছাড়াও দ্বারকা ভারতের সপ্তপুরী নামে পরিচিত সাতটি বিখ্যাত প্রাচীন শহরের একটি। এটি এখানে অবস্থিত ৮০০ বছর পুরনো ও ৫৭ মিটার উঁচু কৃষ্ণ মন্দিরের জন্য বেশ পরিচিত। তবে বর্তমানের এই দ্বারকা শহর মূলত হিন্দুধর্মের দেবতা শ্রীকৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত সেই প্রাচীন নগরীর জন্যই বেশি প্রসিদ্ধ, যা একসময় ডুবে গিয়েছিল সমুদ্রের নিচে। অতীতে এটিকে শুধু পৌরাণিক গল্প হিসেবে মনে করা হলেও ২০০০ সালে এই স্থানে এক প্রত্নতত্ত্বীয় অভিযানে সমুদ্রের নিচে খোঁজ মেলে প্রাচীন এক নগরীর ধ্বংসাবশেষের, যা সেই প্রাচীন নগরী দ্বারকাকেই নির্দেশ করে। চলুন আজকে জেনে নিই সেই প্রাচীন দ্বারকা নগরীর ইতিহাস ও পরিণতি সম্পর্কে।

পৌরাণিক দ্বারকা নগরী
পৌরাণিক নগরী দ্বারকার কথা প্রাচীন ভারত ও হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান মহাকাব্য মহাভারতসহ ভগবদ্গীতা, স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণপুরাণ, হরিবংশ ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে দ্বারকা হল সেই প্রাচীন শহর যেখানে বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণ একসময় বাস করতেন। বিভিন্ন সূত্রানুসারে শ্রীকৃষ্ণ বর্তমান ভারতের দিল্লির দক্ষিণে অবস্থিত উত্তর প্রদেশের মথুরায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

কৃষ্ণের মামা কংস ছিলেন তৎকালীন মথুরার অত্যাচারী রাজা। পরবর্তীকালে কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করেন। ফলে এ খবর শুনে কংসের শ্বশুর, মগধের রাজা জরাসন্ধ রেগে যান এবং এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মথুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু ১৭বার মথুরা আক্রমণের পরও জরাসন্ধ মথুরা জয় করতে ব্যর্থ হন। তবে এই ১৭বার আক্রমণে মথুরার অধিবাসী যাদবরা দুর্বল হয়ে পড়ে। কৃষ্ণ যখন বুঝতে পারেন জরাসন্ধ আর একবার আক্রমণ করলে তারা আর তা প্রতিরোধ করতে পারবেন না, তখন তিনি তার লোকদের নিয়ে মথুরা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।

কৃষ্ণের দ্বারকা প্রতিষ্ঠা
মথুরা ত্যাগের পর কৃষ্ণ নতুন এক শহর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন বোধ করেন। এক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। প্রথমটির মতে কৃষ্ণ গরুড়ে (কৃষ্ণের বাহন) চড়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমের সৌরাষ্ট্রে আসেন এবং সেখানে দ্বারকা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় কাহিনি অনুসারে নতুন এই শহর প্রতিষ্ঠার জন্য কৃষ্ণ নির্মাণের দেবতা ‘বিশ্বকর্মা’র সাহায্য নেন। বিশ্বকর্মা কৃষ্ণকে জানান, যদি সমুদ্রদেব তাদের কিছু জমি প্রদান করেন শুধুমাত্র তবেই এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। কৃষ্ণ তখন সমুদ্রদেবের পূজা করেন এবং সমুদ্রদেব খুশি হয়ে কৃষ্ণকে ১২ যোজন (৭৭৩ বর্গ কিমি) জমি প্রদান করেন। জমি পাওয়ার পর বিশ্বকর্মা সেখানে দ্বারকা নগরী নির্মাণ করেন।

দ্বারকা নগরীর নকশা ও বিবরণ
মহাভারত অনুযায়ী দ্বারকা ছিল শ্রীকৃষ্ণ তথা যদুবংশীয়দের রাজধানী। খুব ভালভাবে পরিকল্পনা করেই দ্বারকা নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরো শহরটি মোট ৬টি ভাগে বিভক্ত ছিল। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, চওড়া রাস্তা, নগরচত্বর, সোনা, রূপা ও দামী পাথর দিয়ে নির্মিত বিশাল বিশাল প্রাসাদ, জনগণের সুযোগ সুবিধার জন্য নানা স্থাপনা সহ নানা উদ্যান ও হ্রদ ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল দ্বারকা নগরী। প্রায় ৭ লক্ষ ছোটবড় প্রাসাদ ছিল এ নগরীতে। এখানে ছিল ‘সুধর্ম সভা’ নামের এক বিশাল হলঘর, যেখানে নানা ধরনের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হত। গোটা নগরীটি ছিল জলবেষ্টিত। এটি ছিল মূলত একটি দ্বীপ-নগর। চারপাশে বেষ্টিত জলরাশি দ্বারকাকে শত্রæর হাত থেকে রক্ষা করত। দ্বারকা নগরী ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। একটি মূল দ্বারকা নগরী ও অন্যটি দ্বীপ-দ্বারকা, যা মূলত ‘বেট-দ্বারকা’ নামেই বেশি প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন সূত্রানুযায়ী এই দুই দ্বারকার মাঝে ছিল অগভীর সমুদ্র। মূল অংশের সঙ্গে দ্বীপ শহরটি নানা ব্রিজ ও বন্দর দ্বারা যুক্ত ছিল। জোয়ারের সময় মূল দ্বারকা থেকে দ্বীপ দ্বারকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। আবার ভাটার সময় যুক্ত হয়ে যেত এ দুটি।

কৃষ্ণ তার বাকি জীবন এ দ্বারকা নগরীতেই অতিবাহিত করেছিলেন। শেষের দিকে তিনি ভাল্কা নামে এক বনে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দুর্ঘটনাবশত এক শিকারীর তীর বিদ্ধ হয়ে নিহত হন। কৃষ্ণের মৃত্যুর পর গোটা দ্বারকা নগরী এক বিশাল বন্যায় সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত সেই দ্বারকা নগরী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর বহু শতাব্দী ধরে বহু সভ্যতার মানুষ সেই স্থানে তাদের শহর নির্মাণ করে এসেছে। বর্তমানে সেখানে যে দ্বারকা নগরী রয়েছে সেটি ঐ স্থানে এমনইভাবে নির্মিত সপ্তম শহর। দ্বারকার মূল মন্দিরটির বর্তমান নাম দ্বারকাধীশ মন্দির।

অনেকের মতে, এই পাঁচতলা মন্দিরটি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত। বর্তমানে দ্বারকা ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় একটি দর্শনীয় স্থান। হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ পৃথিবীর বহু দেশ থেকে মানুষ এ স্থানে বেড়াতে আসেন। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখানে প্রায় ৩৮,৩৮৭ মানুষের বাস রয়েছে।

শুধুই কি গল্প?
দ্বারকা নগরী ও এর পরিণতি কারও কারও মতে শুধুই কাল্পনিক গল্প। তবে অনেকেই আছেন যারা খুব জোরালোভাবেই বিশ্বাস করেন যে, দ্বারকা নগরীর ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। তবে আসলেই এ নগরী ছিল কিনা তা খুঁজতে বহু প্রতœতাত্তি¡ক অনুসন্ধানী অভিযান চালানো হয় বর্তমানের দ্বারকা মন্দিরের সামনের সমুদ্রে। সমুদ্রের নিচের অভিযানে প্রতœতত্ত¡বিদরা খুঁজে পেয়েছেন বহু প্রাচীন এক নগরীর ধ্বংসাবশেষ, যা আনুমানিক প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দীরও পূর্বের।

এই আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে উপক‚লজুড়ে গবেষকরা আরও কয়েকটি অনুসন্ধান চালান। এই অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাস্তবেই বর্তমান দ্বারকা নগরীর সামনের সমুদ্রের নিচে প্রায় ৩৬ মিটার গভীরে রয়েছে প্রাচীন সেই নগরীর বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ। এর মধ্যে রয়েছে পাথর নির্মিত বিভিন্ন আকৃতির নোঙর, ভবন ও দুর্গ তৈরিতে ব্যবহৃত নানা পাথরের ব্লক। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ধ্বংসাবশেষের সবগুলোই প্রায় পঞ্চাদশ শতাব্দীর, যা মহাভারতে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণ নির্মিত সেই দ্বারকা নগরীর সঙ্গে মিলে যায়। এটি প্রমাণ করে তৎকালীন সময়ে দ্বারকা ভারতের অন্যতম ব্যস্ত একটি বন্দর নগরী ছিল। এই আবিষ্কারের ফলে পৌরাণিক দ্বারকা নগরীর অস্তিত্ব কিন্তু চাইলেই আর গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাস্তবেই হয়তো কোনও এক সময় সমুদ্রের কিনারে এই নগরীটির অস্তিত্ব ছিল। হয়তো এটিই একসময় মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে থাকত, যা এখন হারিয়ে গিয়েছে নীল সমুদ্রের অতল গহ্বরে!

তৌফিকুর রহমান, প্রাবন্ধিক।

আরও পড়ুন

মহিষাসুরমর্দিনী : বাঙালির মহালয়া | শঙ্খ অধিকারী

SanatanKatha

মহাভারত: পূর্বাভাস । অনিন্দিতা বসু

SanatanKatha

প্রবন্ধ : সনাতনধর্মে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বিশ্বশান্তি । ড. অসীম সরকার

SanatanKatha